কেয়ামত থেকে কেয়ামত: মিথ্যে হয়নি পোস্টারের সেই ঘোষণা

‘উপমহাদেশের সাড়া জাগানো প্রেমকাহিনির ছবি। আসিতেছে ঈদুল ফিতরের শ্রেষ্ঠ ছবি “কেয়ামত থেকে কেয়ামত”। যে ছবি দেখার জন্য এখন থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে দর্শকদের মধ্যে। সুধী দর্শকেরা বলছেন, এ ছবিই হবে ৯৩–এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফটোসুন্দরী মৌসুমী ও “লাভার বয়” সালমান শাহ অভিনীত “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবি ঝড় তুলবেই।’ মুক্তির আগে এমন কথা লিখে পোস্টার ছাপায় দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ মালিক। পোস্টারের সেই কথা মিথ্যা হয়নি।

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের একটি মাইলফলক হয়ে আছে কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিটি। মুক্তির ৩০ বছরে এসেও এ ছবির আবেদন যেন প্রথম দিনের মতো। সবাই এখনো ছবিটি নিয়ে কথা বলতে ভীষণ ভালোবাসেন, আনন্দ পান। আর কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিটি দিনকে দিন ছবিপ্রেমীদের মনের কোণে আরও শক্তপোক্ত জায়গা করে নিচ্ছে।
১৯৯৩ সালের এই দিনে অর্থাৎ ২৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সোহানুর রহমান সোহানের এ ছবির মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষেরা পেয়েছিলেন দুটি নতুন মুখ—মৌসুমী ও সালমান শাহ। প্রথম ছবিতেই তাঁরা বাজিমাত করেন—অভিনয় দিয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেন। ২৫ বছর আগে সালমান শাহ মারা যান। মৃত্যুর আগে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেন। সব কটি ছিল জনপ্রিয় এবং ব্যবসায়িকভাবে সফল। তবে এক ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে সালমান শাহ মানুষের মনে থাকবেন বহুকাল।

সালমান-মৌসুমীর জন্য নয়, নির্মাণের জাদুতেই ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। এতে শিল্পীর কোনো হাত নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় চরিত্র সালমান-মৌসুমী দুজনই ছিলেন নবাগত। ছবির গুণেই ছবিটি আজও মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। এমনটাই মনে করেন এ ছবির পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। তিনি বলেন, ‘৩০ বছরে এসে কেউ আয়োজন করে আমার সিনেমার কথা স্মরণ করছেন, এটা তো অবশ্যই ভালো লাগার। আমাদের চলচ্চিত্রের জন্যও খুব ভালো দিক। তবে খুব বেশি করে ৩০ বছর আগের দিনটা মনে পড়ছে। কীভাবে ছবিটা মুক্তি পেল, কীভাবে ব্যবসা করল, আমাকে কিংবা আমার ছবির শিল্পীরা এ ছবির বদৌলতে কীভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এই দিনে এসব মনে পড়ছে।’

কেয়ামত-থেকে-কেয়ামত-মিথ্যে-হয়নি-পোস্টারের-সেই-ঘোষণা

কীভাবে এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মৌসুমী? জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছবির প্রস্তাবগুলো আসত গুলজার (পরিচালক মুশফিকুর রহমান) ভাইয়ের মাধ্যমে, তখন তিনি ছিলেন সাংবাদিক। আমার সাক্ষাৎকারের পরিকল্পনা করেন। সোহান ভাই বন্ধু হয়ে ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরে হ‌ুমায়ূন রোডের বাসায় এসেছিলেন। সেখানেই চলচ্চিত্রে আগ্রহী কি না, কৌশলে জানতে চান। তখন আমি স্থিরচিত্র আর বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েই খুশি ছিলাম। মধ্যবিত্ত পরিবার, তাই নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করিনি। গুলজার ভাই বললেন, “ধরুন, হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ যদি বাংলায় রিমেক হয়, আপনি জুহি চাওলার চরিত্রটা করবেন, আমির খানের চরিত্রে নোবেল, তৌকীর আহমেদ কিংবা জাহিদ হাসানও হতে পারেন।” তাঁরা জানতেন, তৌকীর ভাই আর নোবেল ভাইয়ের ভক্ত আমি। তখন কিছুটা আগ্রহী হলাম। কারণ, সহশিল্পী হিসেবে পছন্দের শিল্পীরা থাকবেন। আমি তখন থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করি। কীভাবে বাসায় বলা যায়, উপায় খুঁজছি। এরপর আরও অনেক ছবির প্রস্তাব পেয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বাছাই করতে থাকি, কার ছবি করব? ঘুরেফিরে দেখি, “কেয়ামত থেকে কেয়ামত”।’

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে প্রথম দিনের সংলাপ কী ছিল, জানতে চাইলে মৌসুমী বলেন, ‘প্রথম দিন ক্যামেরার সামনে ভয়ে কাঁপছিলাম। একটি দৃশ্য ছিল, ওই দিন একটা বাইকে সালমান আর আমি এফডিসি থেকে কাঁচপুর গেছি। আবার ফিরে আসি। “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবিতে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ছিল ওটা।’ সালমান শাহর সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল মৌসুমীর। কথায় কথায় তেমনটাই জানালেন ঢালিউডের প্রিয়দর্শিনী খ্যাত এই চিত্রনায়িকা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তখন খুলনায় থাকতাম। ছোটবেলায় ইমন (সালমান শাহর ডাকনাম) আর আমি প্লে গ্রুপ ও নার্সারিতে একসঙ্গে পড়েছি। বাবার চাকরির কারণে ইমনের পরিবার খুলনা সার্কিট হাউসে থাকত। ওই স্কুলে আমার ফুফু ছিলেন টিচার। ফুফুর ছুটি হওয়া পর্যন্ত ইমনদের বাসায় আড্ডা দিতাম। সেও আমাদের বাসায় যাওয়া-আসা করত। ভালো বন্ধুত্ব হয়। এরপর হঠাৎ ওরা ঢাকায় চলে আসে। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর দেখা হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তা ছবিটি করতে গিয়ে নতুন করে টের পাই। ছবির কাজ করার সময় আমাদের দেখা হয়। আবেগাপ্লুত হলাম। অল্প কয়েক দিনেই আমাদের সম্পর্ক আবার আগের রূপ নেয়। নিজেদের সবকিছুই একজন আরেকজনের সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে তো পরিচালক সোহান ভাই একপর্যায়ে ভুল বুঝতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন, আমরা একজোট হয়ে গেছি।’

ছবিটি এতটা সাড়া ফেলবে, ভেবেছিলেন কী? ‘এটা যে প্রেমের আদর্শ গল্প হয়ে যাবে, এই জুটি যে প্রেমের আদর্শ জুটি হবে, প্রিয় জুটি হয়ে উঠবে—ভাবিনি। এত বড় স্বপ্ন মানুষ দেখতে পারে না। যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখা যায়, এই স্বপ্ন যদি দেখতাম, তাহলে স্বপ্ন দেখেই মারা যেতাম। ২৫ বছর সমানতালে জনপ্রিয় থাকবে একটা ছবি, আমাকে “কেয়ামত-কন্যা” ডাকবে! এখনো সালমান মানে আমি, আমি মানে সালমান যে ভাববে, অথবা “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবির প্রতিটি গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে স্পর্শ করবে—এসব ভাবার মতো শক্তি আল্লাহ দেননি। এটা আল্লাহর দান। এটা মানুষ কখনো সৃষ্টি করতে পারে না’, বললেন মৌসুমী।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড হিন্দি ‘সানাম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’–এর কপিরাইট নিয়ে সোহানুর রহমান সোহানের কাছে আসে এর যেকোনো একটির রিমেক করার জন্য। উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে সম্পূর্ণ নতুন মুখ দিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। নায়িকা হিসেবে মৌসুমীকে নির্বাচন করেন। নায়ক হিসেবে প্রথমে তৌকীর আহমেদ ও পরে আদিল হোসেন নোবেলকে প্রস্তাব দিলে তাঁরা ফিরিয়ে দেন। তখন নায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর ‘ইমন’ নামের এক ছেলের সন্ধান দেন। প্রথম দেখাতেই তাঁকে পছন্দ করেন পরিচালক এবং ‘সনম বেওয়াফা’ রিমেকের জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমন ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর জন্য পীড়াপীড়ি করেন। এ ছবি তিনি ২৬ বার দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন ও ইমনের নাম পরিবর্তন করে সালমান শাহ রাখা হয়।

আমির খান ও জুহি চাওলা অভিনীত ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেছেন নাসির হোসেন আর পরিচালনা করেন মনসুর খান। এদিকে বাংলাদেশে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন সোহানুর রহমান সোহান ও সংলাপ লিখেছেন আশীষ কুমার লোহ। প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষের আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেডের ব্যানারে নির্মিত হয় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। ছবিতে সালমান-মৌসুমী ছাড়া আরও অভিনয় করেন রাজিব, আহমেদ শরীফ, আবুল হায়াত, খালেদা আক্তার কল্পনা, মিঠু, ডন, জাহানারা আহমেদ, অমল বোসসহ অনেকে। চলচ্চিত্রটি ১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *