সময় ডেস্ক পবিত্র মাহে রমজানে সারাদিন কষ্ট করে রোজা রেখে একজন রোজাদার ইফতারে পান করছেন নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হওয়া ভেজাল মাঠা। রোজাদার ব্যক্তিদের ক্লান্তি আর চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবছর এসব ভেজাল মাঠা বাজারজাত করে প্রচুর পরিমানে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। তবে এ বছর প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বুঝে না বুঝেই সস্তায় পাওয়া ভেজাল মাঠা পান করছে রোজাদাররা। যা খেয়ে রোজাদাররা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন বলে জানান চিকিৎসকরা। অস্বাস্থ্যকর কারখানাগুলো বন্ধে প্রশাসনের এ বছর নেই তেমন কোনো নজরদারি। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বস্তির মধ্যেই অস্বাস্থ্যকর এবং দূর্গন্ধ যুক্ত নোংরা পরিবেশে বানানো হচ্ছে এসব মাঠা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের ঘোষপাড়া, পুরাণবাজার এলাকার ঘোষপাড়া ও মৈশালবাড়ি এলাকায় এ ভেজাল মাঠার উৎপাদন বেশী হয়। এছাড়া চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়ন দোকানঘরসহ প্রায় অর্ধ-শতাধিক বিএসটিআই এর অনুমোদন বিহীন বাসা-বাড়িতে কারখানা গড়ে তুলে ভেজাল মাঠা তৈরি হয়। পরে ভেজাল মাঠা বিভিন্ন দোকান, পাড়া-মহল্লা ও রাস্তার মোড়ে বিক্রি করা হয়। মাঠার নেই কোন উৎপাদন ও মেয়াদ উর্ত্তিনের তারিখ। অস্বাস্থকর পরিবেশে নষ্ট দুধ, চিনি, লবনসহ আরোও নানা উপাদান মিশিয়ে বানানো হচ্ছে এ মাঠা। এ ব্যবসার সাথে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর আগে অবৈধভাবে বিএসটিআইএর সিল ও অনুমোদন না থাকায় কয়েকটি কারখানাকে ভ্রাম্যমান আদালত জরিমানা করে। এছাড়া বড় বড় মিষ্টানের দোকানে মাঠার কারখানাগুলো থেকে অল্পদামে ক্রয় করে
তাদের নিজস্ব দোকানের নামে স্টিকার করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানাযায়।
শহরের ওয়ারলেস, কালিবাড়ি এলাকায় মাঠা বিক্রেতা রঞ্জন ঘোষ, হারুধনসহ কয়েকজন জানায়, ১লিটার ৮০টাকা, ৫০০ মিঃলিঃ ৪৫ টাকা ও ২৫০ মিঃলিঃ ৩০ টাকা বিক্রয় করা হয়। মাঠার মেয়াদের বিষয় জানতে চাইলে তারা জানায়, বাপ-দাদার সময় থেকে আমাদের এই ব্যবসা। আমরা ২ থেকে ৩ মন দুধ দিয়ে মাঠা তৈরি করি। আর এইগুলো বিক্রয় করেই আমাদের সংসার চলে।
চাঁদপুর সরকারী জেনারেল হাসপাতালের (আরএমও) ডাঃ সূজাউদ্দোলা রুবেল বলেন, নিন্ম মানের মাঠা পান করলে বদহজম, পেট ফাপা, পেট ব্যাথা, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
তবে ইফতারে পচাঁ, বাসী খাবার না খাওয়াই ভাল।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নূর হোসেন রুবেল বলেন, মেয়াদ ও ল্যাভেল ছাড়া মাঠা বিক্রয়ের কোন সুযোগ নেই। পুরানবাজারসহ কয়েকটি স্থানে বাড়িতে বাড়িতে মাঠা বিক্রয় হয়। বাড়িগুলো নির্দিষ্ট করে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
প্রতি বছরই বর্ষার আগে এবং পরে দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এ বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে এবং মার্চের মাঝামাঝি থেকে তা বেশ ব্যাপকহারে বাড়তে শুরু করেছে।
ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে বর্তমানে বেশি।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) দুপুর ২টা পর্যন্ত রাজধানীর আইসিডিডিআরবিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ) ৬৪৩ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন সোমবার (১১ এপ্রিল) গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ১৫৪ জন রোগী। এবছরের ৪ মার্চ একদিনে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৮৩ জন রোগী ভর্তি হয় আইসিডিডিআরবিতে।
আইসিডিডিআরবিতে ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। বাড়তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য টানানো হয়েছে বাড়তি দুটি তাঁবু। শুধু ঢাকার আইসিডিডিআরবি নয়, দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইসিডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ডায়রিয়া, এর প্রতিকার কি বিস্তারিতভাবে বাংলানিউজকে ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, ডায়রিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দূষণযুক্ত পানি। এবারেও তেমনটাই ঘটেছে। আরেকটি কারণ বলা যায়, এবারের দীর্ঘ খরা। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে, পানি কমতে থাকলে দূষণের মাত্রা আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। অত্যধিক গরম পড়লে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পানি বেশি খায়, আর দূষণযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া অনিবার্য।
তিনি আরও বলেন, ভৌগোলিকভাবে ডায়রিয়া কে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। একটা হচ্ছে শহরের মানুষের ডায়রিয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে লবণাক্ততার কারণে মানুষ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করতে পারে না। পুকুর বা অন্য কোনো জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে। খরা হলে পুকুর বা জলাশয়ের পানীয় কমে যায়। এসব পুকুর বা জলাশয় একজন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর কাপড়-চোপড় যদি ধোয়া হয়, পরবর্তীতে যারা এই জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে তারাই ডায়রিয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ঝুঁকিটা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। আরেকটি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল যেখানে ঝর্ণার পানি ব্যবহার করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে অনেক ঝর্ণা থেকে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে পানির প্রাপ্যতা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা যেখানে, যে পানি পায় সেই পানিই গ্রহণ করে। সেই পানি যদি দূষিত হয়, সেখানে যদি ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু থাকে তাহলে তাদেরও ডায়রিয়া হবে।
আইসিডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির বলেন, ঢাকার শহরগুলোতে প্রতি বছরেই দুইবার করে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। বিগত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে দেখছি ঢাকায় ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্তের বেশ কিছু হটস্পট রয়েছে। যেমন যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের বসিলা ও টঙ্গী এলাকায় সাধারণত নিম্নবিত্ত সংখ্যা বেশি। কেন সাধারণত বনানী কিংবা গুলশানে ডায়রিয়া বা কলেরা হয় না? গুলশান-বনানীতে ওয়াসার স্বাভাবিক সরবরাহকৃত পানি পায়, সেখানে পানি পেতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ওই এলাকা গুলোতে অনেকেরই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। কেউ হয়তো মসজিদে কিংবা মাদ্রাসায় থাকে। তারা জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে। এই জলাশয়গুলোতে ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু থাকলে, তাদের ডায়রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এসব নিম্নবিত্ত এলাকায় অনেকেই অবৈধভাবে বা চুরি করে পানির লাইন ব্যবহার করেন। কোনো জায়গায় ফুটো করে পাইপ লাগিয়ে পানি নেয়। এই পাইপগুলো অনেক জায়গায় লুজ থাকে। অবৈধ এই পাইপ যেন দেখা না যায়, সেজন্য বিভিন্ন ড্রেন বা ড্রেনের পাশ দিয়ে নেওয়া হয়। ফলে যখন সাপ্লাইয়ের পানি থাকে না, তখন ড্রেনের পানিও এই পাইপের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এসব পানিতে কলেরা এবং ডায়রিয়ার জীবাণু থাকে। আবার পানির যখন সাপ্লাই আসে তখন এই জীবাণুযুক্ত পানি আবার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে যায়। গ্যাসের স্বল্পতার কারণে তারা পানি অনেক সময় ফুটাতেও পারে না। এই দূষণযুক্ত পানি পান করার ফলে তাদের ডায়রিয়া ও কলেরা হয়।