চাঁদপুরে কমেছে ইলিশের ডিম, বিক্রি হচ্ছে আঁশ

 

স্টাফ রিপোর্টার

ইলিশের শহর চাঁদপুর। ইলিশের মৌসুমে চাঁদপুর মাছঘাটে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ আমদানি হয়। এসব ইলিশ আসে সাগর মোহনা অঞ্চল থেকে। তাছাড়া চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায়ও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘাটে চলে ইলিশের কারবার। প্রতিটি আড়তের সামনে ইলিশের বড় বড় স্তূপ তৈরি করা হয়। পাশেই বরফ ভেঙে প্যাকেটজাত করা হয় ইলিশ।
বরফ ও মাছের চাপ এবং পরিবহনের সময় কিছু ইলিশ নরম হয়ে যায়। একশ্রেণির ব্যবসায়ী এসব ইলিশ অল্প দামে কিনে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন। ইলিশের ডিমও সংরক্ষণ করেন। পাশাপাশি সংগ্রহ করা হয় ইলিশের আঁশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, আড়তগুলোর কর্মচারীরা নরম ও পচা ইলিশ কাটাকাটি করে লবণ দিয়ে নোনা ইলিশ। তৈরি করছেন। মাছের ডিমগুলো আলাদা করে প্লাস্টিকের বক্সে করে সংরক্ষণ করছেন। মাছের আঁশগুলো আলাদা করে পানি ঢেলে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কেউ কেউ। একটু বাড়তি আয়ের জন্য আঁশগুলো আলাদা পরিচর্যা করছেন তারা। এছাড়াও খুচরা ক্রেতারা মাছ কিনে যাদের দিয়ে মাছ কাটান, তারাও এই আঁশগুলো সংগ্রহ করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে আঁশগুলো ক্রয় করে নিয়ে যান। তবে অনেকে জানেন না আঁশগুলো দিয়ে কী করা হয়।
আল আমিন নামে এক কর্মচারী জানান, ইলিশের আঁশগুলো সংগ্রহ করে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। শুকাতে সময় লাগে একদিন। ১০-২০ মণ একসঙ্গে জমিয়ে রাখি। আঁশের মানের ওপর প্রতি মণ ১৫০০- ২০০০ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। ঢাকা থেকে লোক এসে ক্রয় করে নিয়ে যায়। তারা ক্রিম বানায়, মেয়েদের কাপড়ের চুমকি তৈরি করে থাকে।
মাছ কাটার শ্রমিক আশরাফ আলী বেপারী (৭০) বলেন, আমি দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পর থেকে মাছ কাটার কাজ শুরু করি। ইলিশের নোনা তৈরি করি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাছ কাটাকাটি করি। এ সময় মাছের আঁশ সংগ্রহ করি। পরে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। গত ৪-৫ বছর ধরে চট্টগ্রাম থেকে লোক এসে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের আঁশ ক্রয় করে নিয়ে যায়। করোনার কারণে কিছু দিন আঁশ বিক্রি বন্ধ ছিল। এখন আবার আঁশ বিক্রি শুরু হয়েছে। প্রতি মণ আঁশ দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। তবে আঁশ দিয়ে কী করা হয় আমি তা জানি না।
তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ি চাঁদপুর শহরের যমুনা রোডে। আমি এই কাজ করে তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলেকে মানুষ করেছি। তারাও মাছের আড়তে কাজ করে। তারা বিয়ে করে আলাদা সংসার চালায়। আমি আর আমার স্ত্রী এক সাথে থাকি। বর্তমানে মাছ কাটা ও আঁশ বিক্রির টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে।
মেসার্স খান অ্যান্ড সন্স নামে নোনা ইলিশ আড়তের পারিচালক আকাশ খান বলেন, আমরা যেই ইলিশ থেকে ডিম সংগ্রহ করি, ওই ইলিশের সঙ্গে লবণ যুক্ত করে নোনা ইলিশ তৈরি করি। এই মাছ ময়মনসিংহ, জালামপুর, শেরপুর, হালুয়াঘাট এলাকার মানুষের পছন্দ। আমরা মূলত এসব এলাকায় মাছগুলো সরবরাহ করে থাকি। এটার মূল মৌসুম হচ্ছে বৈশাখ মাস। আমরা বৈশাখে এই মাছ বিক্রি করি। এক কেজি ওজনের নোনা ইলিশ ১৩০০ টাকা। এর চেয়ে কম ওজন ৮০০ গ্রামের নিচে ৭০০ টাকা বিক্রি করা হয়।
মাছের ডিম সর্ম্পকে তিনি বলেন, ভরা মৌসুমে ইলিশের সরবরাহ কম থাকায় গত বছরের তুলানায় এ বছর তেমন নোনা ইলিশ সংগ্রহ করতে পারিনি। যার কারণে চাহিদা অনুযায়ী ডিম সরবরাহ করতে পারছি না। আমরা মূলত চট্টগ্রামে ডিম সরবরাহ করে থাকি। তারপর চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে সারাসরি আমেরিকা, লন্ডন, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হয়। গতবারের তুলনায় তেমন লাভ করতে পারি নাই। তবে লসে নাই।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার বলেন, অন্য বছরের তুলনায় নোনা ইলিশ এবার কম হবে। যেহেতু এবার ইলিশ মাছ কম তাই নোনা ইলিশও কম। মাছ যত বেশি নোনা ইলিশও তত বেশি হবে। এই ইলিশের চাহিদা রংপুর, জামালপুর, শেরপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বেশি। এখন ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে রাখবেন। তারা আগামী চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বিক্রি করবেন।
তিনি আরও বলেন, মাছ কম হওয়ার কারণে এবার ডিমও কম সরবরাহ হয়েছে। এখন প্রতিদিন ৩০০-৪০০ কেজি ডিম আমদামি হয়। অনলাইনে বিক্রি হওয়ার কারণে চাঁদপুরের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আমরাও ভাগে পাই না। এখন বড় ডিমের কেজি ১৮০০ টাকা। ছোট ডিমের কেজি ১৩০০ টাকা। যদি মাছ বেশি হতো তাহলে বিদেশে রপ্তানি করা যেত।
শবে বরাত সরকার বলেন, যখন মাছের ডিম হয়, তখন চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের শেষ মৌসুমে। তখন নোনা ইলিশ কাটা হয়। যারা লবণাক্ত ইলিশ কাটেন তারা ডিমটা আলাদা বিক্রি করেন। ইলিশের ডিমের প্রচুর চাহিদা। মাছের আঁশটাও কিছু লোক সংগ্রহ করে রোদে শুকান। পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেন। এই আঁশ কী কাজে লাগে আমি সঠিক জানি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *