নদীর ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজন স্থায়ী পরিকল্পনা

সম্প্রতি চাঁদপুরের নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত না হলেও পানি বৃদ্ধির কারণে শঙ্কা দেখা দিয়েছে নদী তীরবর্তী বসবাসকারীদের মাঝে। বর্ষা মওসুমে নদীর পানি স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যখন এই পানি ধীরে ধীরে নেমে যেতে থাকে তখন নদীর ভাঙ্গন দেখা দেয়। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে প্রতি বছরই চাঁদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব নদী সিকস্তি অসংখ্য মানুষ। এসব মানুষের মধ্যে অধিকাংশের শেষ পর্যন্ত মাথা গোঁজার ঠাই হয় কোন বস্তি কিংবা কোন আশ্রয়ন কেন্দ্রে। সব হারিয়ে তারা ধাবিত হয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
বাংলাদেশের প্রায় সব নদীর চূড়ান্ত উৎস উজানের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে চাপের মধ্যে থাকা স্রোতস্বিনী পলল সমভূমিতে এসে এমনিতেই আড়মোড়া ভাঙতে চায়। স্রোত যখন প্রবল হয়, ভাঙন তখন আরো বাড়ে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ও শেষে বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদ ভাঙনের মুখে পড়ে।

‘ক্রমাগত ভাঙনের রেখা’ কত লম্বা? একটি গ্রাম, বাজার, শহর বা জেলা নয়; মোটামুটি ১২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ। একটি হিসেবে দেখা গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণ মতে, দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর প্রায় তিনশ’ ‘ভাঙনপ্রবণ’ এলাকা স্পষ্ট রয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই সেখানে কমবেশি ভাঙন দেখা দেয়। এর মধ্যে চাঁদপুর অন্যতম।

নদী ভাঙন সাধারণভাবে ‘প্রাকৃতিক’ প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদ-নদীর ভাঙা-গড়াই নিয়তি। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতেও এর ছাপ স্পষ্ট। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান রয়েছে ‘এ কুল ভাঙে, ও কুল গড়ে/এই তো বিধির খেলা/সকাল বেলা আমির রে ভাই/ফকির সন্ধ্যা বেলা’। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে নদী একই এলাকা বছরের পর বছর ভেঙে চলে, বা চলতে দেওয়া হয়; তার নজির আর কোনো ব-দ্বীপে আছে বলে মনে হয় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডেরই একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত চার দশকে কমবেশি এক লাখ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে চলে গেছে। এই ভূমি আসলে কতখানি একটা হিসাব দিলে পরিষ্কার হতে পারে। একেকটি ভাঙন মানে কিছু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। এই ভাঙ্গনে সকালবেলার অনেক আমির সন্ধ্যাবেলা ফকির হয়ে যাওয়া।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এড়ানোর উপায় নেই। বিশেষত বাংলাদেশের মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে আছে। কিন্তু অন্যান্য দুর্যোগের সঙ্গে নদী ভাঙনের পার্থক্য হচ্ছে, ভাঙন কবলিত মানুষ এক ধাক্কায় পায়ের নীচের মাটিটুকুও হারিয়ে ফেলে। বন্যায় সব ধুয়ে গেলে, ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেলেও ভিটে-মাটিটুকু থাকে। কিন্তু নদীভাঙনে সেটুকুও থাকার জো নেই।

তাই মানুষ যাতে আশ্রয়হীন হয়ে না পড়ে সে ব্যাপারেই প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার । এর জন্য নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের কোন বিকল্প নেই। সম্প্রতি চাঁদপুর শহরের সর্বাধিক ভাঙ্গন প্রবণ এলাকায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে যে মতামত ব্যাক্ত করেছেন তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ভেবে দেখা উচিৎ।
তাঁরা বলেছেন, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে তীরবর্তী এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মান করতে হবে । পাশাপাশি যত্রতত্র জেগে উঠা চরগুলোকে অপসারণ করার জন্য আহবান জানিয়েছেন এবং অপরিকল্পিত ড্রেজিং বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলেছেন। আমরা মনেকরি তাঁদের মতামতগুলো আমলে নেয়া উচিৎ।

তাছাড়া স্থায়ী বাঁধ নির্মান না করা হলে প্রতি বছর কিছু জিও ব্যাগ, পাথর বা ব্লক ফেলে এই ভাঙ্গন ঠেকানো যাবে না। সাময়িক নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষায় যে পরিমান অর্থ ব্যায় করা হয় তা একেবারেই অনর্থক। এসব অর্থের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন। এসব অর্থে নদী তীরবর্তী এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মান করা হলে দেশের অর্থের অপচয় রোধ হবে এবং পাশাপাশি মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে আর নিঃস্ব হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *