নৌযান ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে

কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম জুয়েল :
ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় কমবেশি অর্ধশত মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে অন্তত ৭০ জন যাত্রী। লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি আমারা গভীর সমবেদনা জানাই। আহতরা দ্রুত সুস্থ হবেন, নিখোঁজদের সন্ধান মিলবে সেই প্রত্যাশা করি।

দেশে লঞ্চডুবির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু চলন্ত লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে বলে জানা যায়নি। অগ্নিকান্ডের ঘটনা কেন ঘটলো, কীভাবে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করলো- সুষ্ঠু তদন্তে এসব জানা যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। নৌযানটির ফিটনেস, প্রশিক্ষিত ও প্রয়োজনীয় লোকবলসহ পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি না সেগুলোও জানা জরুরি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, লঞ্চটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেছিল। লঞ্চটি ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় দোতলার ডেক বেশ গরম ছিল। এ নিয়ে যাত্রীরা অভিযোগ করলে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তখন কার্পেট বিছিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে গেলে শুরুতে কর্তৃপক্ষ পাড়ে লঞ্চ ভেড়ানোর চেষ্টা করেনি। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া গেলে ক্ষয়ক্ষতি আরও কম হতে পারত বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই লঞ্চটির গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান মেরামতের কাজ করছিলেন। এ জন্য সর্বোচ্চ গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেয়া হচ্ছিল। লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি মেরামত করতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ছাড়া ইঞ্জিনের ট্রায়াল দিতে পারত। কিন্তু তা না করে শত শত যাত্রী নিয়ে ট্রায়াল দেয়ার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটল তার দায় তারা এড়াবে কীভাবে?

বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছেন, আগুন নেভানোর সময় লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাওয়া যায়নি। সেখানে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার কিছুই পাওয়া যায়নি বলে তারা জানিয়েছে।

মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো অমানবিক আচরণ লঞ্চ মালিকদের এটাই প্রথম নয়। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। সরকারি হিসাবে ওই দুর্ঘটনায় প্রায় সাড়ে ছয়শ’ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর হিসাবে এই লঞ্চডুবিকে দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা বলা হয়। এর আগে ও পরে দেশে এরকম বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০২০ সাল পর্যন্ত) দেশের নৌপথে ১২টি বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা ঘটার আগে ও পরে লঞ্চ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভূমিকা সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
র্দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার আরেকটি পরিণতি হচ্ছে গত বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনা। ওই লঞ্চের ইঞ্জিন ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে জানা গেছে। প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই গত অক্টোবর মাসে লঞ্চটির ইঞ্জিন বদলানো হয়েছিল। লঞ্চে অগ্নিকান্ডের দায় মালিকপক্ষ যেমন এড়াতে পারে না, তেমিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও এড়াতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *