এই জন্মদিনেও তাঁকে হ্যাপি বার্থ ডে বলব

বেঁচে থাকলে আজ তিনি পূর্ণ করতেন ৬০। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নেওয়া মানুষটি মাত্র ৫৬ বছর পৃথিবীর আলো–বাতাসে বিচরণ করেছেন। বাবা চেয়েছিলেন, ছেলের এমন একটা নাম হবে, যা অন্য কারও নেই। হয়েছিলেনও তা–ই। গিটার জাদুকর হয়ে কয়েক দশক তিনি মাতিয়েছেন দেশ–বিদেশের গানপ্রেমীদের। জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কথা বলেছেন সংগীতের সহযোদ্ধারা।

মা-বাবার আদরের ছেলে। তাই বলে যে সংগীতচর্চার জন্য খুব একটা অনুকূল পরিবেশ আইয়ুব বাচ্চু পেয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়। বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য সংসারের কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারছিল না তাঁকে। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ ছিল তাঁর। তবে প্রতিভা, এমনকি তার চেয়ে বড় কোনো শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে আইয়ুব বাচ্চু তা-ই। মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে ১৯৮৩ সালে ঢাকায় এসেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। উঠেছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের এক হোটেলে। এরপর বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা হয়ে উঠলেন প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রমে। তাঁর গিটারের ঝংকারে বিদ্যুৎ বয়ে যেত তরুণ-তরুণীদের শিরা-উপশিরায়। তাই তো এমন শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকেন তাঁদের সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। এমনটাই মনে করে ব্যান্ড সংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী মাকসুদও।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় তিনি বললেন, ‘শিল্পী মরে যায়, এটা কখনো বিশ্বাস করি না। বাচ্চুর গান যতবারই বাজে, তাকে নিয়ে ততবার কথা হয়। বাচ্চুর কর্মের পরিধি এত বড়, বলে শেষ করা যাবে না। অনেক কিছু করে গেছে। একাগ্রচিত্তে সে গান থেকে শুরু করে অনেক কিছু চালিয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে ষাট বছরের জন্মদিনে হয়তো বিশাল কিছু একটা হতো।’

মূলত রক ঘরানার গান করতেন আইয়ুব বাচ্চু। শ্রোতাদের কাছে ইংরেজি গান, হার্ড রক, ব্লুজ, অলটারনেটিভ রক নিয়ে গেছেন শুরু থেকে। ব্যান্ড সংগীতের প্রতি তারুণ্যের জোয়ারের ধারা ধরে রেখেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর অনুপ্রেরণা জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর—এমন অনেকেই। কিন্তু শুধু রক বা ব্যান্ডের গানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। আধুনিক গান, লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। লোকগান নিয়ে একটি অ্যালবাম রিমেক করেছিলেন তিনি এবং সেখানে শ্রোতাদের প্রচুর সাড়া মিলেছে। খুব অল্প গান করেছিলেন চলচ্চিত্রে। কিন্তু সেই অল্প কটি গানই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। দেশের ব্যান্ড সংগীতের এই শিল্পীকে জন্মগতভাবে মেধাবী মনে করেন তপন চৌধুরী। এই মুহূর্তে পরিবার নিয়ে কানাডায় আছেন তিনি।

বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘জন্মগতভাবে একজন মেধাবী সংগীতশিল্পী বাচ্চু। আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। খুব কাছের মানুষ। ওর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, এটাই–বা কম কী।’বেঁচে থাকলে আইয়ুব বাচ্চু আরও অসাধারণ কিছু গান উপহার দিতে পারতেন বলেও জানালেন তপন চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘মানুষের বয়স যতই বাড়ে, ততই পরিণত হয়। মিউজিক এমন একটা বিষয়, বয়স যত বাড়ে, ততই পরিপক্ব হয়। অভিজ্ঞতা হয়। আমরা ওর কাছ থেকে অনেক কিছু পেতাম। সংগীতাঙ্গন সমৃদ্ধ হতো। এখন আমরা বঞ্চিত হলাম।’

এই-জন্মদিনেও-তাঁকে-হ্যাপি-বার্থ-ডে-বলব

আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে চমৎকার একটা বন্ধু ছিল, ছিল মান-অভিমানের সম্পর্কও। গতকাল স্মৃতিচারণা করে এমনটাই জানালেন কুমার বিশ্বজিৎ। তিনি বললেন, ‘এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে বাচ্চু কাজ করত না। বেঁচে থাকলে আরও অনেক নতুন কিছু সংস্কৃতিতে যোগ করতে পারত। বাচ্চুর সেই পরিকল্পনাও ছিল। কথা হলে মাঝেমধ্যে এসব নিয়ে বলতও। এই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তরুণেরা লাভবান হতো। ইন্ডাস্ট্রি তো হতোই। আমরা অনেক নতুন গান পেতাম। মিউজিশিয়ানরা আরও নতুন কিছু জানার সুযোগ পেত। কারণ, একজন আইয়ুব বাচ্চু বারবার আসে না।’

চার দশকের বেশি সময় ধরে গানের জগতে আছে ব্যান্ড সোলস। এর মধ্যে ২০০০ সালের পর চার বছরের মতো গানের জগৎ থেকে দূরে সরে ছিল দলটি। আইয়ুব বাচ্চুই আবার বলেকয়ে সোলসকে গানের জগতে ফেরান বলে জানালেন পার্থ বড়ুয়া। এমনকি স্টেজ শোর ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। পার্থ বড়ুয়া গতকাল সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়া থেকে আরও জানান, চট্টগ্রাম থেকে তাঁকে ঢাকায় আনার পর নিজের সঙ্গে কাজে যুক্ত করেন আইয়ুব বাচ্চু। অনেক কিছুই তাঁকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।

পার্থ বড়ুয়া বলেন, ‘জীবনে যা কিছু শিখেছি বা যা কিছুই হতে পেরেছি, তার সবই বাচ্চু ভাইয়ের কাছ থেকেই। আমি মনে করি না, তিনি নেই। তিনি আছেন। আমি এই জন্মদিনেও তাঁকে হ্যাপি বার্থ ডে বলব। তিনি সব সময় আমার মধ্যে বসবাস করেন। আজ আমি যে পেশাদার মিউজিশিয়ান, জাস্ট বিকজ অব বাচ্চু ভাই। আর বাচ্চু ভাইয়ের মা আমাকে বেটা ডাকত। এতেই বোঝা যায়, আমি তাঁর কতটা কী ছিলাম।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *