২ মাসে চিংড়ি কেজিতে কমেছে ৩০০-৭০০ টাকা

স্টাফ রিপোর্টার

করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার মধ্যেই এবার দাম বিপর্যয়ের সংকটে পড়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা। চিংড়ি চাষিদের অভিযোগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এ ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা তাদের দিচ্ছে না, বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণও করছে না। এ অবস্থায় সরকারের বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিংড়ি চাষের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা।

চাষিরা বলছেন, গত দুই মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে ‘সাদা সোনা’খ্যাত চিংড়ির দাম ব্যাপকহারে কমেছে। দুই মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দাম কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো চিংড়ি চাষির অবস্থা এখন শোচনীয়। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কম দামে চিংড়ি কিনে সংরক্ষণ করছে। তবে স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকায় ছোট আকারের চিংড়ির দাম তুলনামূলক বেশি। কিন্তু খুচরায় চাঁদপুরসহ কোথাও এর প্রভাব পড়েনি। বরং দিন দিন যেন বেড়েই চলছে হাট বাজারগুলোতে।

খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস চিংড়ি চাষ। ১৯৮০-এর দশকে থেকে খুলনা এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে লবণাক্ত পানিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়।

সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাছের খাদ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি পোনার দাম বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য কারণেও একসময়ের সম্ভাবনাময় এ শিল্প এমনিতেই চরম সংকটে আছে।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার চকশৈলমারী গ্রামের আধা নিবিড় চিংড়ি চাষি বিপ্রদাস বৈরাগী (৪৪) গত সাত বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছেন। ৫০ শতাংশ জমির পুকুরে চিংড়ি চাষ করেছেন তিনি।

বিপ্রদাস গত বছর ১২ লাখ টাকার চিংড়ি বিক্রি করেছিলেন। সেপ্টেম্বরে প্রতি কেজি চিংড়ি (কেজিতে ১৮-২০টি) ১,২০০-১,৩৫০ টাকায় বিক্রি হলেও, এখন তিনি বিক্রি করছেন ৭১০-৮৩০ টাকায়। তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের পর দুই মাসের ব্যবধানে চিংড়ির দাম অনেক কমেছে। এখন ছোট আকারের চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকায়। মাঝারি আকারের চিংড়ি ৭৩০-৮০০ টাকায়। বড় আকারের (কেজিতে ১২-১৫টি) চিংড়ি ৮৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি, যা আগে বিক্রি করেছি ১,৫০০-১,৬৮০ টাকায়।

বিপ্রদাস বলেন, সরকারের চিংড়ি কেনার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এমন লোকসানে পড়তে হতো না। চিংড়ি শিল্প পুরোটাই বেসরকারি সিন্ডিকেটের দখলে। সরকারের নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে সিন্ডিকেট জায়গা করে নিতে পারত না।

আরেকজন খালশিবুনিয়া গ্রামের মনোজ বৈরাগী ৫ বছর ধরে ৮৫ শতাংশ জমিতে চিংড়ি চাষ করেছেন। তিনি জানান, গত জুনে ৮৫ শতক জমিতে ৮০ হাজার চিংড়ির পোনা ছেড়েছিলাম। ১৩৫ দিন পর বিক্রি করেছি ১৬ লাখ টাকায়। খরচ হয়েছিল ২২ লাখ টাকার বেশি। একটি এনজিও থেকে ৮ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলাম। স্বজনদের কাছ থেকেও কিছু টাকা নিয়েছিলাম। কীভাবে এখন তা শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।

স্থানীয় ইউপি সদস্য পবিত্র রায় দুই বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছেন। তিনি বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় লাভের স্বপ্ন দেখছিলাম। দাম কমে যাওয়ায় সংকটে আছি। এমন সমস্যা হলে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাবে। এই শিল্প গভীর সংকটে পড়বে।

খুলনার কয়রার ব্যবসায়ী ইনসান আলী বলেন, বেশির ভাগ চিংড়ি ইউরোপে যায়। দুই মাস ধরে রপ্তানিকারকরা চিংড়ি পাঠাতে পারছেন না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। এ কারণে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দাম কমাচ্ছে। দুই মাস আগে যে চিংড়ি কেনা হয়েছিল ৯০০-৯৩০ টাকায়, সেগুলো এখন ৫২০-৬০০ টাকায় কিনছি। যেগুলো অন্তত এক হাজার টাকায় কেনা হতো সেগুলো কিনছি ৬৫০ টাকায়।

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে অর্ডার পাচ্ছি না। ডলারের বিপরীতে ইউরো, পাউন্ডের দাম কম হওয়ায় তারা কিনছে না। আমরা জেলি পুশড চিংড়ির বিষয়ে খুব সতর্ক। কিছু অসাধু লোক এটা করে।

ফকিরহাটের বেতাগা এলাকার চিংড়ি চাষি অতুল কাপালি জানান, তিনি প্রায় ৯৫ শতাংশ জমির ৪ পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ করেছেন। খুব কম দামে ১০ মণ গলদা চিংড়ি বিক্রি করেছেন। গত বছর ২০-২২ চিংড়ির কেজি ১২০০ টাকায় বিক্রি করেন। এখন তা বিক্রি করছেন ৮০০-৯০০ টাকায়। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম সোহেল বলেন, চিংড়ির দাম কম থাকায় হাজার হাজার চাষি চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। করোনার পর তারা আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, এক বছর পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কম দামের কারণে তা পারছেন না।

খুলনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে নজর দিতে হবে, যাতে যেখানে চাষিরা ন্যায্যমূল্যে চিংড়ি বিক্রি করতে পারেন। চিংড়ির দাম কম হওয়ায় কৃষক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *