অর্জনে ৫০ বছরে বাংলাদেশ

অর্জনে ৫০ বছরে বাংলাদেশ
অর্জনে ৫০ বছরে বাংলাদেশ

চাঁদপুর সময় রিপোট-১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজে ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তখন স্বাধীনতার জন্য দেশে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী ও পাশবিক এক যুদ্ধ। এ অবস্থায় চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি, ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে তিনি প্রাণবাজি রেখে লড়াই শুরু করেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

শফিকুল ইসলাম একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে বলেন, এটা ছিল পুরোপুরি ধ্বংসযজ্ঞের সময়। আমাদের সেতু-সড়ক সব ধ্বংস হয়ে যায়, নারীদের ধর্ষণ করা হয়, শহরগুলো ছিল অবরুদ্ধ। হাজার হাজার বাড়িঘর ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়া হয়।

যুদ্ধের নয় মাস পরে আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। এরপর কেটে গেছে ৫০টি বছর। ৬৭ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম আজ অ্যারাইভাল ফ্যাশন লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার পরিচালক। ঢাকার অদূরে আড়াই একর জমিতে গড়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের কারখানাটি। সেখানে কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার কর্মী। তাদের হাতে তৈরি পোশাক রফতানি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়।

শফিকুল ইসলামের এমন সাফল্য যেন গোটা বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে ১৬ কোটি মানুষের এই দেশ আজ প্রশংসার ফুলঝুরিতে ভাসছে। যদিও ব্যাপক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জন্ম নেয়া দেশটি এর মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সহিংসতার মতো বড় বড় সংকটের মুখে পড়েছে; তারপরও বিশেষজ্ঞদের চোখে বাংলাদেশ তার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অভাবনীয় উন্নতি করেছে।

লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে এনে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এর বড় কৃতিত্ব অবশ্যই এ দেশের পোশাকশিল্পের।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের অন্তত ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন, নির্যাতিত হন দুই লাখেরও বেশি মা-বোন, প্রাণভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আরও অসংখ্য মানুষ। ভয়াবহ সেই যুদ্ধের আরেক ভুক্তভোগী ছিল অর্থনীতি।

১৯৭২ সালে সদ্যস্বাধীন দেশটির জিডিপি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। সেটি ফুলেফেঁপে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে ৩০৫ বিলিয়ন ডলারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এই জিডিপি ২০৩০ সালেই দ্বিগুণ আকার ধারণ করতে পারে।

দেশের এমন অকল্পনীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান। তৈরি পোশাক রফতানিতে সারাবিশ্বের মধ্যে চীনের পরেই আজ বাংলাদেশের অবস্থান। এই শিল্প থেকে বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করছে বাংলাদেশ। এই খাতে কাজ করছে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ, যার অধিকাংশই নারী।

শফিকুল ইসলামের কারখানায় কাজ করেন নাসিমা আক্তার ও তার দুই সহোদর। সেখান থেকে প্রতিমাসে তাদের আয় হয় প্রায় ৪১১ ডলার (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা), যা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই চলছে তাদের সংসার।

নাসিমা জানান, তিনি যখন কিশোরী ছিলেন, তার বাবা-মা দিনে তিনবেলা খাবার জোগাড় করতে প্রায়ই হিমশিম খেতেন। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। ২৮ বছর বয়সী এ নারী দিনে আট ঘণ্টা কারখানায় কাজ করেন, সেখানকার আয় দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাচ্ছে দিনকাল।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তার শাসনামলে দেশের মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বেশ কয়েক বছর ধরেই নারী ও কন্যাশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। বর্তমানে দেশটির ৯৮ শতাংশ শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হচ্ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আজ ছেলের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি।

বাংলাদেশিদের গড় আয়ু এখন ৭২ বছরে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পাকিস্তানিদের গড় আয়ু মাত্র ৬৭ বছর। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, শিশুপুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যের লড়াইয়ে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এটা দারুণ এক যাত্রা। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর জন্য উন্নয়নের রোল মডেল।

তবে আশঙ্কাও রয়েছে কিছু। বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। সামুদ্রিক পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে এদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সূত্রমতে, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা একেবারেই সামান্য, মাত্র ০.৩৫ শতাংশ। তারপরও দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের একটি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাছাড়া সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিও বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দাঁড় করিয়েছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী লকডাউন দিতে হয়েছিল। এতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ বহু কল-কারখানা, থমকে গিয়েছিল ছোট ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনার ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কম দেখা যায়।

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়, কৃষি ও পরিসেবা খাতের মতো অন্য অর্থনৈতিক চালকগুলোও বেশ ভালো করছে।

তবে এখানেই শেষ নয়। শেখ হাসিনা আরও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বাংলাদেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

সেই পথে এগিয়েও যাচ্ছে এ দেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটি (ইউএনসিডিপি)।

মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলামের মতে, তার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের এখনো অনেক অর্জন বাকি।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি, আর কখনোই পেছন ফিরে তাকাইনি। কারণ আমরা জানতাম, স্বাধীনতা আসবেই। অন্যথায়, এই জাতি বাঁচবে না। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। এখনো অনেক পথ যেতে বাকি, আর আমাদের হৃদয় সবসময় মাতৃভূমির সঙ্গে রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *