‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল’

 

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভাষা আন্দোলনের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার কারাবরণ করলেও তার অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে উনার কোনো অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। এর গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারো নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কী অবদান ছিল? উনি তো জেলেই ছিলেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।

তিনি বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ, এম আর আক্তার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম, আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কী করেছেন, এখানে সব বিস্তারিত আছে। ফাইলটা দিলাম; আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন। কারণ, ওনারা তো (সমালোচক) অনেক উঁচু মাপের লোক। আমাদের মত ছোট চুনোপুটিরা কিছু লিখলে তো হবে না, সেজন্য। পরে অবশ্য সেগুলো ১৪ খণ্ডের পুস্তক আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তার ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ আছে।

বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল, অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেল, আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে। এখনকার প্রজন্ম যার অনেক কিছু জানেও না।

তিনি বলেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা, এমনকি রবীন্দ্র সঙ্গীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে। কিন্তু, আমরা তখন আন্দোলন করেছি সকলে মিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ সারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এভাবেই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো দানা বেঁধেছে। আর সেই সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি, আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেন সুন্দরভাবে বিকশিত হয় এবং আমরা বাঙালি এই বাঙালি হিসেবেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলবো। আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। এই দেশকে আমরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাব উন্নয়নের পথে।

তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি সালাম ও রফিক এবং ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ নামক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করেন। তাদের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জোর প্রচেষ্টাতেই ইউনেস্কো অমর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না, বৃথা যায়নি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের সেই অবদান আমরা সব সময় স্মরণ করি।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণিজন সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণিজন আছেন, যাদের অনেকে নামটি পর্যন্ত জানে না। এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাদের অবদানকে সকলের সামনে নিয়ে আসাই সরকারের প্রচেষ্টা। এজন্য সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।

এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সঙ্গীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুজন, শিক্ষায় একজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা, ভাষা ও সাহিত্যে একজন করে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। শিল্পকলা বিভাগে অভিনয় ক্যাটাগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সঙ্গীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) এবং রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং ৪ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন পদক বিতরণ পর্ব সঞ্চালনা ও পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর স্বাগত বক্তৃতা করেন।

মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *