বাংলা গানের দুই অক্ষয় তারা

রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীন অথবা সাবিনা ইয়াসমীন ও রুনা লায়লা। যে ক্রমেই বলি না কেন, তাতে এ দুজনের কীর্তির মহিমার বিন্দুমাত্র ক্ষয় হয় না। বরং বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রে দ্বৈত কণ্ঠে তাঁদের গাওয়া একটি গান নিয়ে বলতে পারি। গানটির কথা ছিল, ‘তুমি, তুমি বড় ভাগ্যবতী’, উত্তরে অন্য একজন বলছেন, ‘না না তুমি, তুমি বড় ভাগ্যবতী’। দুজনই যে ভাগ্যবতী, সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। উপরন্তু, এই দুজন শিল্পীর একই সঙ্গে আমাদের গানের ভুবনে আবির্ভাব হয়েছে বলে বাংলা গানের ভুবন যে অনেক অনেক ভাগ্যবতী, সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীন—দুজনই সংগীত পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। আমরা এই দুজন শিল্পীকে যখন পেয়েছি, তখন আমাদের সংগীত পরিচালকদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের গান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতা দেখেছি। কারণ, এ দুজনের কণ্ঠে রয়েছে ভিন্ন রকম মাধুর্য। একজনের কণ্ঠে প্রচুর জোয়ারি। আরেকজনের কণ্ঠ আবার বাঁশির মতো, কোথা থেকে কোথায় যায়, কোথায় আসে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এই দুটি ধরনই গানের সম্পদ। অনেক জোয়ারি থাকা কণ্ঠে, এমনকি মধ্যম পর্যন্ত গেলেও মনে হয় যেন, বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে কণ্ঠ। এই সুবিধা আমরা রুনা লায়লার গানে সব সময়ই পেয়েছি।

রুনা লায়লার গান সম্পর্কে বলার আগে তাঁর সম্পর্কে একটুখানি বলি। তার পিতা চাকরিজীবী ছিলেন। বদলির চাকরি ছিল তাঁর। তাঁদের আদি বাড়ি রাজশাহী হলেও রুনা লায়লার জন্ম হয় সিলেটে। তাঁর পিতা তখন সিলেটে চাকরি করতেন। এরপর অতি অল্প বয়সেই তাঁর বাবা বদলি হয়ে যান তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে। রুনা লায়লাও চলে যান। মূলত তাঁর শৈশব, তারুণ্য, যৌবনের প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত সেখানেই কেটেছে। তাঁর কণ্ঠের যে মাধুর্য, তা আমরা এত দূর থেকেও শুনেছি। শুধু উর্দু অডিও গানের নয়, উর্দু চলচ্চিত্রের গানেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী নূরজাহানের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এটা কিন্তু একটি তরুণীর পক্ষে খুব সহজ কথা নয়। তখন তাঁর বয়স খুবই কম। যাঁর জন্ম ১৯৫২ সালে, ১৯৭০-এ তিনি মাত্র ১৮! যৌবনের প্রারম্ভ। এই সময়েই তিনি নিজেকে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন সেই বিভাষী, যে ভাষা তাঁর নয়, উর্দু ভাষার গানে। আমরা সেই সময় তাঁর দুটি বাংলা গানও শুনি। একটি ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’, আরেকটি হচ্ছে ‘আমি নদীর মতো কত পথ ঘুরে তোমার জীবনে এসেছি’। এ দুটি গানই চমকে দিয়েছিল আমাদের, এ কোন কণ্ঠ! কারণ, বাংলা গানে এই কণ্ঠ প্রথম আমরা শুনি।

সাবিনা ইয়াসমীনের গড়ে ওঠা একেবারে নিয়মবদ্ধভাবে। তিনি ছোটবেলা থেকেই গান শিখেছেন। তাঁর সব বোন সংগীতের বিশেষজ্ঞ, বিশেষভাবে প্রাজ্ঞ। একটি দৃশ্যের বর্ণনা দিই। তখন সব চলচ্চিত্রের গানের রেকর্ডিং হতো এফডিসিতে। মনো রেকর্ডিং। কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পীর সমন্বয়ে একত্রে রেকর্ড করা হতো। কোথাও কোনো যন্ত্রশিল্পীর এতটুকু ভুল হলে পুরো গানটিকে আবারও শুরু থেকে গেয়ে আসতে হতো। তাতে একটি গান রেকর্ড করতে সারা রাত লেগে যেত। এই গানটি ছিল দ্বৈত গান। পুরুষ শিল্পী দাঁড়িয়ে আছেন, সম্ভবত মাহমুদুন্নবী। পাশে একটি টুল রাখা ছিল। সেই টুলের ওপর একটি বালিকা উঠে দাঁড়াল। এই বালিকাটি কোনো শিশুশিল্পীর জন্য নয়, নায়িকার জন্য কণ্ঠ দিচ্ছেন। গানটা রেকর্ড হলো। আমরা জানলাম, এই বালিকাটির নাম সাবিনা ইয়াসমীন। কে তিনি? তিনি ফরিদা ইয়াসমীন, ফৌজিয়া ইয়াসমীন, নিলুফার ইয়াসমীনের বোন—সাবিনা ইয়াসমীন। তিনি সর্বকনিষ্ঠ। এবং গান শুনতে শুনতে একবারও মনে হলো না যে এটা নায়িকার কণ্ঠের গান নয়। আর চলচ্চিত্র যখন মুক্তি পেল, তখন দেখা গেল, নায়িকার কণ্ঠের সঙ্গে এই কণ্ঠ একেবারেই এক হয়ে গেছে। এটা একটি শৈলী। একেক নায়িকার জন্য কণ্ঠে একটু রকমফের করে গাইতে হয়। এটা প্লেব্যাক শিল্পীরা জানেন। ওই বালিকাকালেই সেটা জেনে গিয়েছিলেন সাবিনা। এভাবেই আমরা সাবিনা ইয়াসমীনকে পেয়েছি।

রুনা লায়লা জুগনু ছবিতে প্রথম উর্দু গান গেয়েছিলেন এবং সেটি ১৯৬৫ সালে। ওই বছরই তিনি রেকর্ডিং করেছেন ফিল্মের জন্য, মাত্র ১৩ বছর বয়সে। সেখানে এত এত শিল্পী থাকা সত্ত্বেও রুনা লায়লা সেই যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। রুনা লায়লাকে নিয়ে সারা পৃথিবীতে বহু কিছু হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তিনি ভক্ত ছিলেন পাকিস্তানি শিল্পী আহমেদ রুশদীর। আহমেদ রুশদীর ধরনের গান তিনি খুব পছন্দ করতেন। তাঁর সঙ্গে রুনা লায়লার অনেক দ্বৈত গান আছে। সেসব গানে দুজনের রসায়ন দারুণভাবে রক্ষিত হয়েছে। শুনলে মনেই হয় যেন একে অপরের জন্য গাইছেন।

রুনা লায়লার গান শেখার বিষয়টি কিন্তু বড় অদ্ভুত। তাঁর বড় বোন দিনা লায়লা ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন, রুনা লায়লা তাঁর পাশে বসে থাকতেন। বসে থেকেই তিনি কিন্তু উচ্চাঙ্গসংগীতের সব রস গ্রহণ করেছেন। পরে তিনি ওস্তাদ গোলাম কাদিরের কাছে তালিম নিয়েছেন। তিনি একেবারে ভিন্ন ঘারানার লোক। মেহেদী হাসানের বড় ভাই তিনি। সাবিনা ইয়াসমীন প্রথমত গার্হস্থ্যভাবে শিখেছেন, বাড়ির সবার কাছে। তারপর ওস্তাদ পিসি গোমেজের কাছে তিনি তালিম নিয়েছেন। এই যে দুই তারকা একই সঙ্গে আমাদের আকাশে ভেসে উঠল, কোনটা সন্ধ্যাতারা, কোনটা সুখতারা আমরা জানি না। কিন্তু এ দুটিই অক্ষয় তারা, যাঁরা আজও গেয়ে চলেছেন আমাদের জন্য।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, রুনা লায়লা বাঙালির সন্তান। বাংলা গান করেছেন, উর্দু গান গেয়েছেন। পৃথিবীর প্রায় ১৭টি ভাষায় গান করেছেন। সাবিনা ইয়াসমীনও তেমনি বাংলার পাশাপাশি উর্দু ও হিন্দি গান করেছেন। এই বাংলাদেশে একসময় উর্দু ছবি নির্মিত হতো, সেখানে তিনি গান করেছেন। ভারতের জন্য হিন্দি ভাষায় গান করেছেন। এ গানগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়। আমরা এ কারণেই এই দুজন শিল্পীর যে প্রভা, যে বিদ্যুচ্ছটা আমাদের চোখেমুখে এসে লেগেছে, যার কোনোটা থেকেই আমরা চোখ ফেরাতে পারি না। এ দুজন আমাদের সংগীতজীবনে বহু গানকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন তাঁদের কণ্ঠের জাদুতে।

সাবিনা ইয়াসমীন যেমন চলচ্চিত্রের গান, তেমনি আধুনিক বাংলা গান, তেমনি দেশের গান—প্রতিটি জায়গাতে অমলিন। যেন মনে হয় এই গান গাওয়ার জন্যই তাঁর জন্ম। এমনকি বাংলা লোকগীতিতেও। মজার বিষয় হলো, রুনা লায়লার শিক্ষা ভিন্ন ধরনের হলেও আমাদের লোকগীতিতে তিনি তাঁর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এবং অনেক লোকগানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন, অনেক গোল্ডেন ডিস্কও হয়ে গেছে। দুজন শিল্পীর মধ্যেই বহুমুখিতা ছিল, আছে। যত দিন এ দুজন জীবিত থাকবেন, আমরা তত দিন এই দুজনের কাছে ফল্গুধারার মতো চাইব। আমি এই দুজন শিল্পীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করতে গিয়ে যে চমৎকার বিষয়টি দেখেছি, গান কী বলতে চায়, বাণী কী বলতে চায়, সুরে কীভাবে অনুবাদ হয়েছে, সেটিকে তাঁরা ধারণ করতে পারতেন অসম্ভব দক্ষতায়। ‘আমার মন পাখিটা যায় রে উড়ে’, রুনা লায়লা যখন গেয়েছেন, তখন মনেই হয়নি যে এই শিল্পী বাংলাদেশের পাড়াগাঁ দেখেননি। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ময়দানে তাঁর বিচরণ নেই, মনেই হয়নি। আবার একইভাবে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে’ গানটি শুনি, তখন এক মহান ব্যক্তিত্বের কথা মাথায় আসে। সত্যিই বাংলাদেশের প্রতি অত্যন্ত গভীর অনুভব না থাকলে এই গান গাওয়া যায় না। সাবিনা ইয়াসমীন এমন গানও করেছেন, ‘আমি আর কাঁদব না/ লাখো সন্তান হারানো স্বদেশ তোমাকে কথা দিলাম/ তোমারই মতন করে বিশ্বাসে বুক বাঁধলাম/ আমি তো হারানো একটি ছেলের মা, আমি আর কাঁদব না।’ আবার তিনি যখন গেয়েছেন, ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, তখন সে মায়ের সন্তানের যে অনুভূতি আমার বুকে কাজ করেছে, সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ যেন তার চেয়েও ঝকঝকে এক আয়না হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার রুনা লায়লা ‘আমাকে একটি দোয়েল বলেছে’ গানে, দোয়েল থেকে যখন নদীতে এসেছে, তাঁর কণ্ঠে তখন আশ্চর্য এক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ‘আমাকে একটি নদী বলেছে, এ কূল ছেড়ে গেলে আমি গান ভুলে যাব, আমি সুর ভুলে যাব’। ‘একটি দোয়েল’ বলার সময় দোয়েলের মতো তীক্ষ্ণতা, ‘নদী’ বলার সময় সেটা অনুভব করে নদীর চলনের মতো করে গেয়েছেন।

অসামান্য প্রতিভা দুজনই। এই দুই প্রতিভাকে নিয়ে সারা রাত ধরে কথা বলা যায়। দুজনকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন করে বললে তো আরও অনেক কিছু বলা যায়। আমি ভিন্ন ভিন্নভাবে বলতে চাই না, কোনো রকম তুলনা আনতে চাই না। কারণ, দুজনই অতুলনীয়। আমি তাঁদের যত গান গাইতে শুনেছি, যেমন সাবিনা ইয়াসমীন যখন নঈম গহর সাহেবের লেখা ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’ গানটি পরিবেশন করেন, তখন কেন যেন আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরে পড়ে। অপূর্ব সুন্দর, এত হৃদয় দিয়ে গান করা যায়! আবার যখন রুনা লায়লার কণ্ঠে শুনি ‘স্বাধীনতা এক গোলাপ ফোটানো দিন’, তখন হৃদয় যেন গোলাপের মতো ফুটে ওঠে। আসলেই তো, শিল্পীরা কণ্ঠে যে ছবি এঁকে দেন, সুরকারের স্কেচ ধরে ধরে রঙে ভরে দেন, সেই রঙের প্রাচুর্য, সুষমা যখন মিলেমিশে একাকার হয়, হৃদয়ে তখন একটি ভিন্ন ভাবনা, একটি ভিন্ন চিত্রের জন্ম নেয়। এই ভাবনা ও চিত্র নিয়ে আমরা চিরকাল ধন্য থাকতে চাই। আমরা কত দিন বাঁচব জানি না। কিন্তু এই দেশ থাকবে, এই দেশের অসংখ্য শ্রোতা থাকবেন, অসংখ্য সংগীতপ্রেমী থাকবেন, গীতিকবি থাকবেন, অসংখ্য সুরস্রষ্টা থাকবেন। তাঁরা লিখবেন, তাঁদের গানে রুনা-সাবিনা কণ্ঠ দান করবেন। তাঁদের কাছে এই দুটি কণ্ঠ যেন আজীবন শুধু নয়, আমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হতে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কোনো দিন ম্লান হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *