কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম জুয়েল
চাঁদপুরের গ্রামের অর্থনীতির বড় অংশ অবৈধ সুদ ব্যবসায়ীদের দখলে। গরীব কৃষক একশ টাকায় ১০ থেকে ২০ টাকা সুদে টাকা নিচ্ছেন। চৈত্র মাসে কৃষক যে টাকা কর্জ নেন, তার সুদ পরিশোধ করেন ধানের বিনিময়ে। কোথাও কোথাও টাকা ও ধান দুটোই দিতে হয়। সময় মতো টাকা দিতে না পারলে উঠান থেকে ধান তুলে নেয়ার ঘটনা অহরহ। শুধু কৃষক নন, কন্যা দায়গ্রস্ত পরিবার, সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের চিকিৎসার জন্যও সুদের টাকা কর্জ করেন গ্রামের মানুষ। জুয়া ও নেশার জন্যেও সুদে টাকা নেওয়ার অভ্যাস আছে। শুধু ব্যক্তি নয়, সমিতির মাধ্যমেও চলে সুদ বাণিজ্য। গ্রামে গ্রামে সমিতি তৈরি হয়েছে। তারা সমবায়ের নামে টাকা তুলে, সেই টাকা সুদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। সমিতির সুদের টাকা না দিতে পারলে, পুরো সমিতিই গ্রহীতার ওপর হামলে পড়ে।
সম্প্রতি সুদের টাকার দ্বন্দ্বে খুন-খারাবির মতো ঘটনাও ঘটছে। করোনাকালে এই সুদ ব্যবসা আরও রমরমা হয়েছে। মানুষের কাজ শূন্য হওয়া, ব্যবসায় ধস বা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেলে কর্জ করে আবার উঠে দাঁড়ানো চেষ্টা করছে, পরিবারের সংকট সামলে নেওয়া। ব্যবসায় পুনঃবিনিয়োগের জন্য মানুষ নিরুপায় হয়ে ব্যক্তি বা সমিতির কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়েছে, নিচ্ছে। যারা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন, তারা চেষ্টা করছেন টাকা ফেরত দেওয়ার। যারা পারেননি, তারা অসহায় হয়ে প্রিয় সম্পদের যেটুকু আছে তাই কর্জদাতার হাতে তুলে দিচ্ছেন। যারা পারছেন না, তাদের কেউ কেউ ঘর ছাড়া। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গ্রামীণ সুদের এই অর্থনীতির কথা স্থানীয় প্রশাসনের অজানা নয়। অর্থনীতির চিন্তকদের কাছেও পরিচিত। গ্রামে কৃষি ও শিল্প অর্থনীতির প্রসার ঘটছে। নতুন ফসল যুক্ত হচ্ছে। কৃষি-শিল্প অর্থনীতি তৈরি করেছে নতুন সম্ভাবনা। টেকসই ইঙ্গিতও রয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণের জোগান নিশ্চিত করা যায়নি। কৃষকদের দশ টাকার একাউন্ট খুলে দেওয়ার পরও তাদের করা যায়নি ব্যাংকমুখী। সরকারি সমবায়ের জটিল আমলাতন্ত্র ও ভোগান্তি সমবায় বান্ধব করতে পারছে না প্রান্তিকজনদের। তাদের কাছে সুদ ব্যবসায়ীরাই সহজলভ্য। এই সহজলভ্য অর্থের জোগানদারদের সহজ সেবায় কঠিন হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জীবন। নিঃস্ব এবং দেউলিয়া হচ্ছে মানুষ।
করোনাকাল সুদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে। সেই চাঙ্গা অর্থনীতি আমাদের প্রান্তিক অর্থনীতির স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে। এদিকে অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ব্যারিস্টার সুমনের করা এক রিটের শুনানি নিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ৪৫ দিনের মধ্যে সারা দেশের সুদ কারবারিদের তালিকা করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তালিকা করার সময় কারও নাম পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আশা করি চাঁদপুর জেলায়ও এ আদেশ দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।