মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা মানছে না জেলেরা

 

এম কে এরশাদ

চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনার আশপাশের চরাঞ্চলসহ সর্বত্র ইলিশ ধরার উৎসব মুখর হয়ে । নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জেলেরা। জেল-জরিমানা এমনকি সরকারি নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করেই অবাধে চলছে ইলিশ নিধন। জেলেরা পাল্লা দিয়ে ইলিশ শিকার করছে দিনে ও রাতে। তবে এদের বেশিরভাগই মৌসুমী ইলিশ শিকারি বলে দাবি জেলেদের মনছেনা কোন নিষেধাজ্ঞাই । জেলেদের আটক করলে বেপরোয়া হয়ে পুলিশের উপর মারমুখি হয়ে উঠে।
এদিকে স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে লালপুর এলাকায় নদীর পাড়ে ইলিশ বেছাকিনারে হাট বসে এবং বিক্রি করছে ইলিশ। প্রায় ৮০ থেকে ১শ নৈাকা নদীতে নামছে । তবে সেখানে জেলেদের দাদন দিয়ে নদীতে নামিয়ে লীড দিচ্ছেন মোঃ ছলেমান দর্জি (৫৫) মোঃ গনি দর্জি (৫৩) মোঃ বাচ্চু বেপারী (৫২)সহ বেশ কয়েক জন। তাদের নিয়ন্ত্রনে চলে ইলিশ বেছাকিনা। লালপুর মাছঘাটে ১৮ অক্টোবর রাতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় সবখানে সুনশান নিরবতা। ঘাটের এক দোকাদার ইসমাইল হোসেন চাঁদপুর সময়কে জানান, এখানে রাতে কোন মাছ আসে না। মাছ আসে ভোরে। তখন খাটে অনেক নারী পুরুষ জড়ো হয় মাছ কেনার জন্য। তবে কেউ জেলেদের কাছ থেকে সরাসরি মাছ কিনতে পারেন না। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, এখানের আড়ৎদাররা দাদন দিয়ে রেখেছেন। তাই তারাই মাছ কিনে তারপর ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। এখানে প্রতিহালি মাছ প্রায় ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।
চাঁদপুর শহরের রনাঘোল এলাকায় যারা জেলেদের দাদন দিয়ে নদীতে নামাচ্ছেন তারা হলেন, মোঃ লিটন গাজী,(৪৫) মোঃ শাহাজান গাজী,(৫০) মোঃ রফিক শেখ,(৪২) পুরান বাজার ফায়ার সারবিস এলাকার মোঃ শাহাদাত পাটওয়ারী,(৪৮)সহ রনাঘোলের অনেকে রয়েছে এই ইলিশ বেছাকিনা নদীর পাড়ে আরালে চলে রাত বোর। অন্যদিকে সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নে দোকান ঘোর এলাকার মোঃ আসলাম মাঝি,(৫৮) মোঃ মিজান পাটওয়ারী,সহ কয়েকজনের নেতৃত্বে চলছে নদীতে নৈাকা নামিয়ে ইলিশ শিকার রাতে চলে বেছাকিনা। হানাচর ইউনিয়নে হরিনা ঘাট এলাকা মোঃ নেছু ছৈায়াল,(৪৫) মোঃ ফারুক ছকিদার, মোঃ বাশার মেম্বার (৪৫) মোঃ সিদ্দিক,সহ বেশ কয়েকজন সেখানে প্রায় ১শ নৈাকা নদীতে দাদন দিয়ে জেলেদের নামিয়ে ইলিশ বেছাকিনা করছে। চাঁদপুর নৈা থানার পাশে পুলিশের নাকের ডগায় শহরের ৭ নং ওয়ার্ড টিলাবাড়ী এলাকা থেকে প্রতিদিন নৈাকা নদীতে যাচ্ছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টা যারা নিয়ন্ত্রন করছেন তারা হলেন আলী হোসেন,(৫৫) মোঃ নুরে আলম,(৫২) মোঃ ছোবাহান,(৫৫) আবুল কালাম,(৫৬) মোঃ জাকির হোসেন মোঃ শাহআলমসহ বেশ কয়েকজন এর নেতৃত্বে চলে ইলিশ বেছা কিনা। এদিকে চাঁদপুর মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি ইউনিয়নের জনতা বাজারের দক্ষিণ মুক্তিপল্লী বাজারে (অস্থায়ী বাজার) দেদার বিক্রি হচ্ছে মা ইলিশ। বাজারের আড়ৎদাররা প্রকাশ্যে ইলিশ মাছ বিক্রি করছে।
গোপন সূত্রে জানাযায়, উপজেলারর ফরাজীকান্দি ইউনিয়নের দক্ষিণ রামপুর গ্রামের দেলোয়ার বেপারী তার ছেলে মিঠুন বেপারী, মুক্তিপল্লী গ্রামের শামসুল দেওয়ান, বালুচর গ্রামের দুলাল দেওয়ান ও নজু বকাউল তাদের নেতৃত্বে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নাই। স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের মোকাবিলা করার জন্য রিজার্ভ রয়েছে স্থানীয় উশৃঙ্খলদের নিয়ে গঠিত ক্যাডার বাহিনী।তাদের দেখভাল করেন মিঠুন বেপারী। সে দক্ষিণ রামপুর গ্রামের দেলোয়ার বেপারীর ছেলে।এব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধীক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনকে শ্রদ্ধা করে মাছ বিক্রি বন্ধ রেখেছি। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দেলোয়ার বেপারী, মিঠুন বেপারী, শামসুল দেওয়ান, দুলাল দেওয়ান ও নজু বকাউল তাদের নেতৃত্বে আড়ৎ খোলা রেখে মাছ বিক্রি করছে।
চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাট এলাকার জেলে হোসেন ও বিল্লালসহ আরও একাধিক জেলে বলেন, ‘সরকারি নিবন্ধিত জেলেরা নিয়ম মেনে নদীতে না নামলেও এক শ্রেণির মৌসুমী জেলে অবাধে ইলিশ ধরছে। প্রতিবছরই ওইসব জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে ইলিশ ধরে অনেক টাকা কামিয়ে নেয়। কিন্তু আমরা নিয়ম মানলেও সরকারি সামান্য সহযোগিতায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই।’
শহরের বড়স্টেশন ও আনন্দ বাজার এলাকার জেলে খোরশেদ ও শাহিন মোল্লা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেকে সরকারের আইন না মেনে নদীতে মাছ ধরছে। টাকাও রুজি করছে। আর আমরা নিয়ম মেনে কষ্টে দিন কাটাইতেছি। সরকার কি আমাগো দিকে ভালভাবে নজর দিতে পারে না? ২০ কেজি চাল দিয়েতো আর আমাদের সংসারের অভাব মিটে না।’
এদিকে ইলিশের নিরাপদ বংশ বিস্তারে গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে ইলিশ প্রজনন মৌসুম। যা আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৯০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশসহ সকল ধরনের মাছ আহরণ, বিপণন, মওজুদ, ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে সরকার। আর তা বাস্তবায়নে দিনরাত নদীতে বিচরণ করছে জেলা ট্রাস্কফোর্সের সদস্যরা। কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় মা ইলিশ শিকার। কতিপয় অসাধু নিবন্ধিত জেলে ও মৌসুমী জেলেরা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পর্যাপ্ত ইলিশ প্রাপ্তিতে হুমকি বলে দাবি করেন ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ইলিশের নিরাপদ বংশ বিস্তারের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় এরা তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলে। এছাড়াও এই সময়ের বেশিরভাগ ইলিশের পেটে ডিম রয়েছে। আর তা ধরে ফেললে আগামীতে ইলিশ উৎপাদন কমে যাবে। তাই নির্দ্দিষ্ট সময়ে ইলিশ না ধরার আহ্বান জানান তিনি।’
পদ্মা-মেঘনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ইলিশ ধরছে জেলেরা। তারা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুযোগ পেলেই দলবদ্ধ হয়ে নেমে পড়ছে নদীতে। আর অবাধে শিকার করছে ডিমওয়ালা মা ইলিশ। যদিও জেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও মৎস্যবিভাগ ২৪ ঘণ্টাই নদীতে বিচরণ করছে। কিন্তু ওইসব জেলেরা প্রশাসনের লোকজনকে নজরে রেখে সুযোগ বুঝেই নদীতে নামছে। আর আহরণকৃত ওইসব ইলিশ দাদনদারদের পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া মহল্লাসহ কৌশলে গ্রামের বিভিন্ন বন জঙ্গলে এবং হাটবাজারে গোপনে বিক্রি করছে।
চাঁদপুর নৌ-পুলিশের এসপি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের নৌপুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে। প্রতিদিনই আমরা জেলেসহ জাল ও ইলিশ জব্দ করছি। এরপরও ওইসব জেলেদের আমরা আটকাতে পারছি না। তবে আমাদের সদস্যরা আন্তরিকভাবেই কাজ করছে।’
তবে নিবন্ধিত জেলেরা নদীতে নামছে না দাবি করে চাঁদপুর কান্ট্রি ফিশিং বোর্ড মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মালিক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের নিবন্ধিত জেলেরা নদীতে নামে না। প্রতিবছরই এই সময়ে মৌসুমী জেলে, মৌসুমী আড়ৎদার ও পাইকার গড়ে ওঠে। এরা সারা বছর অন্য পেশায় থেকে নিষেধাজ্ঞার সময়ে বেশি লাভের আশায় নদীতে নামে। বর্তমানে ওইসব মৌসুমী জেলেরা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিতে স্পিডবোট দিয়েও মাছ ধরে। তাছাড়া এই বিশাল নদীতে প্রশাসনের দু-একটা টিম দিয়ে কোনো সফলতা আসবে না।’
অপরদিকে, চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন গত ১২ দিনে ৬০৮ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও ১৬ কোটি মিটার কারেন্ট জাল ও সাড়ে ৩ টন ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত ইলিশ বিভিন্ন এতিমখানা ও মাদ্রাসায় বিতরণ করা হয়। আর অবৈধ কারেন্ট জাল প্রশাসনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে বিনষ্ট করা হয়।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগ থেকেই জেলেদের সরকারি নিয়ম মানতে উদ্বুদ্ধ করেছি। পাশাপাশি তাদের ইতোমধ্যে ভিজিএফ’র চালও দেওয়া হয়েছে। এরপরও অনেকে নদীতে নামছে। তবে এদের বেশিরভাগই মৌসুমি জেলে। এরপরও আমরা তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। কিন্তু বিশাল এই নদী এতো কম জনবল দিয়ে আর শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই এই সম্পদ রক্ষার্থে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এদিকে শিকমন্ত্রী চাঁদপুর ৩ আসন এমপি বলেছেন জেলেদের দাদন দিয়ে যারা নদীতে নামাচ্ছেন তাদের আইনের আওতায় আন্তে হবে। অনেকে তাদের লীড দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করুন তাহলেই নদীতে ইলিশ শিকার বন্ধ হবে।
গতকাল বুধবার নৌপুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম মৎস্য সম্পদ মা ইলিশ সংরক্ষণে জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি নৌপুলিশ নৌপথে বিভিন্ন ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে। মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গত ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত, পরিবহণ ও বিনিময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে নৌপুলিশের ১২২টি থানা ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া, বিষখালী, পায়রা, কচা, পশুর, রূপসা, বলেশ্বর, হাতিয়া চ্যানেলসহ মা ইলিশ বিচরণের উল্লেখযোগ্য নদী ও সমুদ্র উপকূলে অভিযান পরিচালনা করছে। গত ১২ দিনের এই অভিযানে নৌপুলিশ নৌপথে অবৈধভাবে মৎস্য শিকারের জন্য ব্যবহৃত মোট ৬১ কোটি ৪৭ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৭ মিটার জাল, ২৭ হাজার ২২৬ কেজি মাছ, ১৮৬টি মামলা, ২৯৬টি মোবাইল কোর্ট ও ১৮৭৬ জনকে আটক করে। নৌপুলিশ বলছে, আগামী ২৮ অক্টোবর এই অভিযান শেষ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *