চাঁদপুরে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার বাবুই পাখির বাসা

 

এম কে এরশাদ

চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলা স্থানে তালগাছে শোভা পাচ্ছে বাবুইপাখির বাসা। শৈল্পিক কারুকাজে সজ্জিত এই বাসস্থান দেখলে যে কারো ভালো লাগবে। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে ভরপুর। পাতায় পাতায় বাদর ঝোলা হয়ে লেগে থাকতো এক সময় । এখন কিছু উপজেলায়
তাল গাছ তাকলেও গাছ নিধনের ফলে এখন কমে যাচ্ছে তাল গাছ। একসময় তালগাছ মানেই ছিল বাবুই পাখির বাসা। অথচ সেই তালগাছও এখন বিপন্ন প্রায়।

গ্রামবাংলার অতি পরিচিত বাবুই পাখি তার নিপুণ ছোঁয়ায় তৈরি করতো নিজ বাসা। সেই বাসা দেখতে যেমন ছিল সুন্দর তেমনি পাখির বসবাসের জন্য ছিল মজবুত। সেই নিপুণ শৈল্পিকতা কবি সাহিত্যিকরা তাদের কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এখন আর আগের মত চোখে পড়ে না বাবুই পাখির বাসা। দুই একটি গাছে বাসা থাকলেও তাতে পাখি এখন থাকে না। যে কারণে আমাদের প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্প নৈপুন্য।

প্রবীনদের মুখে শোনা যায়- নারিকেল, তাল, খেঁজুর, কাশ ও আখ প্রভৃতি গাছের পাতা এবং লম্বা শক্ত ঘাস মুখে করে এনে একটি গাছে তিন প্রকারের বাসা

 

নির্মাণ করতো বাবুই পাখি। এর মধ্যে একটি বসবাসের জন্য, একটি ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটানোর জন্য এবং একটি খাবার সংগ্রহ করে রাখার জন্য। বাসা

নির্মাণের জন্য তারা সাধারণত তালগাছকে বেছে নিতো।

এই চিত্র আগে চাঁদপুর জেলার সর্বত্র দেখা গেলেও এখন খুব সীমিত হয়ে পড়েছে তালগাছ। তাই একান্ত প্রত্যন্ত গ্রাম ছাড়া বাবুই পাখির বাসা এখন আর

তেমন নজরে পড়ে না।

কারণ অন্যান্য গাছের ডালপালা ঝড়ে ভাঙার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু তালগাছের ডালপালা না থাকায় ভাঙার সম্ভাবনা কম, এক্ষেত্রেও বাবুই পাখির চরম

বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃতি থেকে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বাসা তৈরি করতে পারছে না পাখিরা। যে কারণে বাবুই পাখি

প্রজনন করতে না পারায় ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রকৃতির এই নিপুণ শিল্পীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

বাবুই পাখির বাসা উল্টানো দেখতে কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়া ঘাসের আস্তরণ ছাড়ায়। যত্ন করে পেট দিয়ে

ঘষে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গাও তৈরি করা হয়। অন্য দিকটি লম্বা করে

প্রবেশ ও প্রস্থান পথ থাকে। কথিত আছে- বাবুই পাখি চালাকও কম নয়। রাতে বাসায় আলো জ্বালাতে জোনাকি পোকা ধরে এনে বাসায় গুঁজে রাখে।

বাবুই পাখি যত্ন করে তালপাতা, কাশবনের পাতা, খড়কুটো দিয়েই উঁচু তালগাছে, নারিকেল, কড়ই, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাসা যখন উঁচু তাল গাছে

দোল খায়, তখন দারুণ লাগে। তাদের শৈল্পিক চিন্তা এতই প্রবল ঝড় কিংবা তুফানেও কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে

বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে।

এরা লম্বায় ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮-২২ গ্রাম। পুরুষ ও স্ত্রীর দেহের রঙে বেশ পার্থক্য আছে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষের দেহে রঙের যথেষ্ট

পরিবর্তন হয়। পুরুষের মাথার চাঁদি সোনালি-হলুদ হয়ে যায়। কান-ঢাকনি ও গাল হালকা বাদামি থেকে সাদা। ঘাড় ধূসর-কালো ও গলা সাদা। বুকে চওড়া কালো ফিতা। পেট ফিকে সাদা, যাতে হালকা বাদামি বা হলদের ছোঁয়া। পিঠে কালচে লম্বালম্বি দাগ। প্রজননকালের স্ত্রী অন্য সময়ে চেয়ে কিছুটা উজ্জ্বল,

অনেকটা শীতের পুরুষের মতো।

স্ত্রী ও প্রজননহীন পুরুষ মাথা ও ঘাড়ের ওপর কালচে ডোরা, যার মাঝখানে হলুদ। দেহের ওপরটায় লম্বালম্বি হলুদ ও কালচে দাগ। ভ্রু ও গলা হলুদ, কান-

ঢাকনি বাদামি ও পেট পীতাভ। বুকের উপরের কালো ফিতা অসম্পূর্ণ। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চোখ হালকা বাদামি, ঠোঁট কালচে। পা, আঙুল ও নখ হালকা

গোলাপি। মে থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকালে নদীর তীরে বা জলার ধারে নলখাগড়া বা উঁচু ঘাসে ২০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা কিছুটা ডিম্বাকার বাসা বানায়,

যা বাবুই পাখির বাসার তুলনায়। একই জায়গায় সচরাচর দুই থেকে পাঁচটি বাসার কলোনি দেখা যায়। পুরুষ পাখি বাসা বানায়, অর্ধসমাপ্ত বাসা স্ত্রী পরখ

করে। পছন্দ হলে জোড় বাঁধে। স্ত্রী দুই থেকে চারটি সাদা ডিম পাড়ে। প্রায় দুই সপ্তাহে ডিম ফোটে। বাচ্চারা এক মাসের মধ্যে উড়তে শেখে।

এক সময় গাঁও-গ্রামে বুননশিল্পী পাখি ও বাসার সন্ধানে পাখিপ্রেমীরা ছবি তুলতে, কিচির-মিচির শব্দ শোনার জন্য আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতেন। এখন

 

আর তেমন একটা বাবুই পাখি চোখে পড়ে না। পড়ে না নয়নাভিরাম বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। গাঁও-গ্রামের আকাঁবাঁকা মেঠোপথে, পতিত উঁচু

ভিটেমাটিতে, কখনও কখনও বাড়ির সীমানায় শোভাবর্ধন তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা শোভা পেত। তা দেখে মানুষ মুগ্ধ হতো। এখন সেই তালগাছও

প্রায় বিপন্ন হতে চলছে।

বাবুই পাখি বিরল প্রকৃতির। গাঁও-গ্রামে তাল গাছ, নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ ও কড়ই গাছে তারা দল বেঁধে বাসা বাঁধে। এই বাবুই পাখি পরিবেশ বিপর্যয় ও

বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা দায়িত্ব সবার। তাই চাঁদপুরে এখন আর তেমন দেখা মিলেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *